এই ধারনাটি সঠিক হতে পারত যদি চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে থাকত ফেরেশতাগণ। খুব অল্প সংখ্যায় ডাক্তার বা পুষ্টিবিদ আসলেই রোগীর স্বার্থকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন।
অনেকেই তাদের চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে সর্বশেষ গবেষনাগুলো সম্পর্কে জ্ঞ্যাত নন। আর তারা শিখবেনইবা কিভাবে? রোগীরা আমরা এমন লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি যে ওনারা রাত ২টা অব্দি রোগী দেখতেই ব্যস্ত থাকেন। লেখাপড়ার জন্য সময় দেবার ফুসরতই পান না। তাছাড়া লেখাপড়ার জন্য সময় খরচ করলে রুজিও খানিক কমে যায়, তাই না?
আরো সমস্যা আছে। একজন বিশেষজ্ঞ যদি বলেন যে তাঁর পুরনো চিকিৎসাগুলো ভুল ছিল, রোগীরা তখন তাঁর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন, যা একজন চিকিৎসকের যশ এবং উপার্জনের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভুল ধারনাই আকড়ে ধরে থাকা বেশী সহজ। ডাক্তার কে বাঁচাতে 'গাইডলাইন' তো আছেই। রোগী মরে মরুক!
বিষয়টি এতটাই দৃষ্টিকটু যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে আপত্তি তোলেন সম্প্রতিঃ https://www.bd-pratidin.com/first-page/2023/03/03/863811
"২য় ধরনের ডায়বেটিস একবার হলে আর কোনদিন সারে না, ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে" এমন কথা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়, যদিও কথাটি কিন্তু একদমই ভুল কথা।
২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগটি আসলে একটি খাদ্যাভ্যাস জনিত অসুখ। অতি মাত্রায় শর্করা জাতীয় খাবার বেশি ঘন ঘন খাওয়ার ফলে এই অসুখের সূচনা হয়। ইংল্যান্ড এর নামকরা ডাক্তার ডাঃ ডেভিড আনউইন বলেন যে, ডায়বেটিস অসুখ হল এমন একটা অবস্থা যখন আমাদের দেহ শর্করা (চিনি) জাতীয় খাবার সহ্য করতে পারে না এবং রক্তের মধ্যে তা জমে থাকে। তাহলে এই অসুখের সমাধানের উপায় হল, শর্করা খবারগুলো বর্জন করা! অর্থাৎ একজন ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগী যদি সীমিত শর্করা ভিত্তিক খাবার খান এবং ঘন ঘন খাওয়ার পরিবর্তে দিনে ২ বা সর্বোচ্চ ৩ বেলা খান, তাহলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তার অসুখ সেরে যাবার কথা।
এই কথা সঠিক হলে, ডাক্তারগণ কেন রোগীদের ঘন ঘন শর্করা জাতীয় খাবার খেতে বলেন? হয়তো সেটা অজ্ঞতা থেকেই করেন তারা। তবে তাদের এই পরামর্শ কেউ অনুসরণ করলে, তার ডায়বেটিস ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে এবং তারা ধীরে ধীরে একাধিক জটিল অসুখে আক্রান্ত হতে থাকেন এবং এক সময় অকাল মৃত্যুর মাধ্যমে বিদায় নেন। তখন ডাক্তারের কথা কে সবাই সঠিক বলেই মনে করেন।
"২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগীর দেহে ইনসুলিন ঘাটতি থাকে" এমন কথা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়, যদিও কথাটি কিন্তু একদমই ভুল কথা।
২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগটির শুরু হয় যদি বহু বছর ধরে দেহের ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা, দিনের অধিকাংশ সময় স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বেড়ে থাকে। সুস্থ্য অবস্থায় প্রতিবেলা খাবার খাওয়ার পরে দেহে ইনসুলিন হরমোন বাড়ে এবং খাবার থেকে রক্তে ঢুকে পরা চিনিকে, আমাদের পেশির মধ্যে জমা করে বা চর্বি আকারে জমা করে। অর্থাৎ ৩ বেলা খেলে, ৩ বেলা ইনসুলিন বাড়ে এবং প্রতিবারেই তার পরের ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে তা স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে যায়।
কিন্তু আমরা যদি ঘন ঘন খাবার খেতে শুরু করি, যেমন প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর খাই, তাহলে প্রথমবার খাবার খাওয়ার পরে যে ইনসুলিন বাড়ে, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে, সেটা আর স্বাভাবিক হবার সুযোগ পায় না। অর্থাৎ, সকাল ৮টায় প্রথম নাস্তা খেয়ে, রাত ১১টায় যদি শেষবার খেয়ে ঘুমাতে যান, তাহলে সকাল ৮:৩০ থেকে রাত ২:০০টা অব্দি আপনার রক্তে উচ্চ মাত্রায় ইনসুলিন উপস্থিত থাকবে।
এই কথাটি অতি সামান্য ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। যারা ৩০/৪০ বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস রোগে ভুগছেন, তাদের অগ্নাশয়ের নিরাময় অযোগ্য ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সেই ঘটনা ঘটলে তখন সেই অবস্থা কে ১ম ধরনের ডায়বেটিস বলা হবে।
জেনে রাখুন যে ১ম এবং ২য় ধরনের ডায়বেটিস এর মধ্যে পার্থক্যই হল যে প্রথম ধরনের ডায়বেটিস হলে প্যাঙ্ক্রিয়াস বিকল হয়ে যায় এবং ইনসুলিন উৎপাদনে অসমর্থ হয় এবং অন্যদিকে ২য় ধরনের ডায়বেটিস হলে প্যাঙ্ক্রিয়াস মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনে বাধ্য হয়।
ইনসুলিন হরমোন দেহে চর্বি জমা করার কাজ করে। ২য় ধরনের ডায়বেটিস রোগীর দেহে অতিরিক্ত মাত্রায় ইনসুলিন উপস্থিত থাকে বলে, তাদের দেহে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি জমে তাদের ওজন বেড়ে যায়। দেহাভ্যন্তরের অঙ্গগুলোতেও চর্বি জমে এবং এদের স্বাভাবিক কাজে বাধা হয়ে দাড়ায়। অগ্নাশয়ে চর্বি জমে গেলে, তখন ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হয়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিলে, দেহ জমে থাকা চর্বি ভেঙ্গে চলতে শুরু করে। আর সুখবর হচ্ছে যে, দেহ সর্ব প্রথম ব্যবহার করে যকৃত বা অগ্নাশয়ে জমে থাকা চর্বি। আর অগ্নাশয়ের চর্বি পুড়িয়ে ফেললে, অগ্নাশয় আবার ইনসুলিন উৎপাদন শুরু করে। গবেষক ডঃ স্টিভেন ফিনি এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে, অগ্নাশয় বিকল হয়ে যাবার ধারনা কে ভুল বলে দাবি করেন।
সিডনীর ডাক্তার পল মেসন তার আলোচনায় বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। প্রথমত এলডিএল আসলে কোলেস্টেরল নয় বরং কোলেস্টেরল পরিবাহী ডুবোজাহাজ যা রক্তের মধ্যে দিয়ে কোলেস্টেরল পরিবহনের কাজ করে। অর্থাৎ এলডিএল কে কোলেস্টেরল বলা আসলে এক ধরনের বোকামি। কিন্তু তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য, সেটা হল যে কোলেস্টেরল বেশি থাকলে, তা হৃদরোগ ঘটাবে, এই কথা এখনো কোন গবেষণায় প্রমাণিত নয়।
অবাক হবেন জানলে যে, উল্টো প্রমাণ দেখা গেছে আসলে অনেক গুলো নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার ফল থেকে। সিডনি ডায়েট হার্ট স্টাডি নামে একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, উদ্ভিজ্জ্য তেল খাইয়ে অংশগ্রহণকারিদের এলডিএল এর মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে, সেই দলে অন্য দলের তুলনায় অধিক মানুষ মৃত্যুবরন করেন। তাদের হৃদরোগের মাত্রাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি ছিল। একই সময়ে আমেরিকায় সম্পাদন করা হয় আরেকটি গবেষণা যা মিনেসোটা করোনারি গবেষণা নামে প্রসিদ্ধ। কয়েকটি মানুষিক হাসপাতালে, যেখানে রোগীদের বাইরে থেকে কোন খাবার পাওয়ার উপায় ছিল না, গবেষকগণ রোগীদের দুই দলে ভাগ করে, এক দলকে প্রাণীজ চর্বির পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ্য তেল সমৃদ্ধ খাবার খেতে দেন। তাদের রক্ত পরীক্ষায়ও এলডিএল কমতে দেখা যায়। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায় সেই একই রকম চিত্র। এলডিএল কমানো দলের মধ্যে বিবিধ কারণে রোগীর অসুস্থ্যতা এবং মৃত্যুর মাত্রা দেখা যায় অনেক বেশি।
ভাবছেন, এই তথ্য সাম্প্রতিক তথ্য কিনা? নাহ, তা নয়। সেই সত্তুরের দশকে এই গবেষণাগুলো সম্পাদিত হয়েছিল। তাহলে আপনার ডাক্তার সেই কথা জানেন না কেন? কারণ, এই ফলাফল সেই গবেষকদের পছন্দ হয়নি বিধায় তারা এর প্রতিবেদন প্রকাশ করেন নি। সম্প্রতি ২০১৩ এবং ২০১৬ সালে এই গবেষণার উপাত্ত পুরাতন তথ্য ভাণ্ডার থেকে উদ্ধার করে, নতুন একদল গবেষক, সেই উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে এই ফল প্রকাশ করেন।
ডাক্তার পল মেসন এর মুখেই এই তথ্যগুলো জানতে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ https://youtu.be/tICJUNXfaO0
প্রফেসর রবার্ট লাস্টিগ (শিশুদের হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ) বলেন যে প্রায় সব ডাক্তারই রক্তের লিপিড প্রোফাইল পড়তে ভুল করেন। কারো হৃদরোগের ঝুঁকি কতটা তা, তাদের রক্তে কতটা ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কতটা এইচডিএল আছে, সেখান থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ভাবে নির্ণয় করা যায়। যদি কারো ট্রাইগ্লিসারাইড মাত্রা কে এইচডিএল মাত্রা দিয়ে ভাগ করলে, ভাগফল ১.৫ এর কম হয়, তাহলে তাদের এলডিএল বেশি থাকলে বরং তারা বেশি ভাল থাকবেন। আর ওই ভাগফল যদি ২ এর বেশি হয়, তাহলে অন্য কিছুর পেছনে না ছুটে, চেষ্টা করতে হবে এই ফল কে ১.৫ এর কাছে নামিয়ে আনতে।
এর পরে যদি কোন ডাক্তার আপনাকে ডিমের কুসুম ফেলে খেতে বলেন বা চর্বিহীন মাংস খতে বলেন বা ঘি খেতে নিষেধ করেন, তাহলে বুঝবেন যে আপনি ভুল বিশেষজ্ঞের পেছনে পয়সা ঢালছেন।
গ্লুকোজ যা এক ধরনের চিনি, মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। একজন সুস্থ্য পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দেহে গড়ে ৫ লিটার রক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এই রক্তের মধ্যে এক চা চামচ পরিমাণ বা ৫ গ্রাম চিনি উপস্থিত থাকে। আমাদের দেহ রক্তে চিনির এই মাত্রা কে স্থির রাখার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখে। চিনির এই পরিমাণ কমে গেলে বা বেড়ে গেলে, দেহ সাথে সাথে সংশোধনী পদক্ষেপ নেয় এবং চিনি বাড়িয়ে বা কমিয়ে ৫ গ্রাম পরিমাণে স্থির রাখে।
নিশ্চয় ভাবছেন যে চিনি বেড়ে গেলেতো ইন্সুলিন হরমোন বেরিয়ে এসে সেটাকে কমাতে পারে, কিন্তু কমে গেলে তা বাড়ায় কি করে? সঠিক মাত্রায় চিনি আমাদের দেহে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের যকৃতের মধ্যে চিনি উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। আমাদের কলিজার মধ্যে গ্লুকোনিওজেনেসিস (বা নতুন চিনি উৎপাদন) নামের একটি প্রক্রিয়া আছে যার মাধ্যমে, রক্তে চিনি কমে গেলে, দেহ সাথে সাথে চিনি উৎপাদন করে তা সংশোধন করে।
এবং সেই কারণেই, খাদ্য হিসাবে সারা জীবনে এক কনা চিনি না খেলেও, আমাদের দেহে কখনোই চিনির অভাব হয় না।এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই সম্প্রতি বিজ্ঞানীগণ শর্করা কে অনাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান বলে ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু মস্তিষ্ক তো মানব দেহের সব থেকে সক্রিয় এবং সর্বাধিক ক্যালরি পোড়ানো অঙ্গ, তাহলে আমাদের যকৃৎ কর্তৃক উদপাদিত চিনি দিয়ে কি তার শক্তির চাহিদা মেটানো সম্ভব?
একথা সত্য যে দেহের ওজনের মাত্র ২% হলেও মস্তিষ্ক একাই আমাদের প্রাত্যহিক ক্যালরি চাহিদার ২০% বা তার বেশি ব্যাবহার করে। এবং এ কথাও ঠিক যে, চর্বিকনা, রক্ত এবং মস্তিষ্কের মধ্যের পর্দা (ব্লাড ব্রেইন ব্যারিরার) ভেদ করে প্রবেশ করতে পারে না। সেকারণেই একসময় মনে করা হত যে চিনি না খেলে আমাদের মস্তিষ্কের শক্তির অভাব হবে এবং তার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল যে, রক্তে স্বাভাবিক মাত্রায় চিনি থাকলে (অর্থাৎ সারা শরীরে ৫গ্রাম), দেহ, যে সকল অঙ্গ চর্বি কনা ব্যাবহার করে শক্তি উৎপাদন করতে পারে, তাদেরকে চিনি ব্যাবহারে নিরুৎসাহিত করে। ফলে, প্রায় সবটুকু চিনিই তখন মস্তিষ্কের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় এবং মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় চিনি আমাদের দেহ সহজেই উৎপাদন করে দিতে পারে।
অন্যদিকে, রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে, দেহ ইন্সুলিন হরমোনের প্রভাব মুক্ত থাকে। ইন্সুলিন বেড়ে না থাকলে, দেহ, দেহে জমে থাকা চর্বি ভাঙ্গিয়ে শক্তি উৎপাদন করা শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে, আমাদের যকৃৎ কিটোন নামক এক ধরনের পানিতে দ্রবণীয় জ্বালানী তৈরি করে যা যকৃৎ ব্যাবহার করতে পারে না এবং রক্তে মিশিয়ে দেয়। এই কিটোন আবার অতি সহজেই মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, রক্তে কিটোন এর মাত্রা যতই বাড়ে, মস্তিষ্ক তার একটি নির্দিষ্ট হিস্যা/ভাগ শুষে নেয়। অর্থাৎ, কিটোন এর মাত্রা ১০ হলে যদি মস্তিষ্ক ৩ পরিমাণ শুষে নেয়, কিটোন মাত্রা ১০০ হলে, মস্তিষ্ক ৩০ মাত্রা শুষে নেয়, ২০০ হলে ৬০ মাত্রায় শুষে নেয়, ইত্যাদি। এই ঘটনা থেকে বিজ্ঞানীগণ সিদ্ধান্তে আসেন যে, কিটোন হচ্ছে মস্তিষ্কের প্রিয় জ্বালানী।
পরবর্তী ভাবনা অবশ্যই যে, রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক থেকে কমে গেলে তখন মস্তিষ্কের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে কিনা। গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ দিন উপোষ করিয়ে রাখার পরে, অংশগ্রহণকারীদের দেহে যখন কিটোনের মাত্রা বেশ উচ্চ মাত্রায় রয়েছে, তখন ইন্সুলিন ইঞ্জেকশন দিয়ে তাদের রক্তের চিনি মাত্রা ০.৫ মিলিমোল পর্যায়ে নামিয়ে আনার পরেও তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন যেখানে ৩.৫ মিলিমোলের কম হলেই তাকে বিপদজনক হিসাবে দেখা হয়। ডঃ জর্জ কেহিল এর করা এই গবেষণা প্রতিবেদনটি পড়লে অনেক কিছু বুঝতে পারবেনঃ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC292859/pdf/jcinvest00269-0113.pdf
মানব দেহের এই চমৎকার ব্যবস্থাপনার কারণেই ১৯৭৩ সালে, পরিক্ষামূলকভাবে একজন স্কটিশ ব্যাক্তিকে ৩৮২ দিন অভুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছিল। শুধু পানি, লবণ এবং একটি ভিটামিন ক্যাপসুল প্রতিদিন খেয়ে তিনি ৩৮২ সুস্থ্য অবস্থায় ছিলেন। অতিরিক্ত ওজন নিয়ে এই পরীক্ষায় তিনি অংশ নেন এবং পরীক্ষা শেষে একজন স্বাভাবিক ওজনের মানুষে পরিণত হন। এই গবেষণার প্রতিবেদনটি পড়তে হলে, এইখানে ক্লিক করুন। নিচে অ্যাঙ্গাস বারবেরির ছবি দেয়া হল (উৎসঃ https://www.diabetes.co.uk/blog/2018/02/story-angus-barbieri-went-382-days-without-eating/)
গ্লুকোজ স্বল্পতা বা হাইপো হচ্ছে রক্তের চিনি কমানোর ঔষধ ব্যবহারের একটি কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। রক্তের চিনি কমানোর জন্য যারা ইন্সুলিন ইঞ্জেকশন নেন অথবা শক্তিশালী চিনি কমানোর ঔষধ খান (যে দুটোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোকামি) এবং তার পরে কোন চিনি খান না, তারা হাইপো আক্রান্ত হতে পারেন। উক্ত ঔষধ গুলো সেই সকল রোগীর জন্য উৎপাদন করা হয়েছে যারা খাদ্যাভ্যাস ভিত্তিক কোন পরিবর্তন করতে অসমর্থ। কিন্তু কেউ যদি খাবার থেকে শর্করা (যা রক্তের চিনির কারণ) বাদ দেন, কিন্তু ঔষধ আগের মতোই গ্রহণ করেন, তাদের রক্ত থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ কমে গিয়ে হাইপো হতে পারে যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
দেহে চিনি উৎপাদনের প্রয়োজন পড়লে, দেহ প্রাকৃতিক ভাবেই করটিসল হরমোন উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের কলিজার কাছে সংকেত পাঠায় যেন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় আমাদের যকৃৎ চিনি উৎপাদন করে রক্তে মিশিয়ে দেয়। রক্তে এই করটিসল বেড়ে গেলে, কয়েক মিনিটের জন্য আমরা কিছু উপসর্গ অনুভব করি যেমন অস্থির লাগা, গা ঘামা, হাল্কা কাঁপুনি হাওয়া, পিপাসা ইত্যাদি। খেয়াল করে দেখবেন যে কোন বিপদে পরলেও আমাদের এই অনুভূতি হয়ে থাকে কেননা বৈরি পরিবেশে এই একই প্রক্রিয়াটি চালু হয়ে আমাদের দেহ "যুদ্ধ কর, নয়তো পালাও" কাজের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। এই অবস্থা টি একটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় ঘটনা এবং এতে ভয়ের কোন কারণ নেই।
একজন ২য় ধরনের ডায়বেটিক রোগী যিনি ইন্সুলিন ব্যবহার করেন না, বা কিডনি দিয়ে চিনি বের করে দেবার শক্তিশালী ঔষধ ব্যবহার করেন না, তার ক্ষেত্রেও হাইপো হবার কোন কারণ নেই।
তাই সুস্থ্য মানুষ তো বটেই, এমনকি ডায়বেটিক রোগী যারা এখনো ওই ঔষধগুলো ব্যবহার করেন না, তাদের হাইপো হবার ভয় নেই।
এই তথ্যটুকু আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডাঃ এরিক ওয়েস্টম্যান এর একটি ইমেইল থেকে অনুবাদকৃত।
কিটোসিস কি বিপদজনক?
নাহ! চলুন এই বিভ্রান্তি কে চিরদিনের জন্য মিটিয়ে ফেলি।
কিটোনগুলো আসলে কি?
কিটোন হচ্ছে দেহের জ্বালানী। সহজ এবং সংক্ষেপে, তাই। আমাদের দেহের সব কোষই যেমন শর্করা এবং চর্বি থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারে, ঠিক তেমনি, কিটোন থেকেও পারে। আমাদের কিছু অঙ্গ আছে যারা কিটোন ব্যাবহারে বিশেষ পটু, যেমন হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক। শর্করা খাওয়া কমিয়ে দিলে, একারণেই হয়তো অধিকাংশ মানুষের মনের মেঘ কেটে যায়।
উপকারী কিটোসিস কে বিপদজনক কিটো-আসিডোসিস এর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না!
শর্করা খাওয়া ভীষণভাবে কমিয়ে দিলে দেহে পুষ্টিকর বা উপকারী কিটোসিস হয়, যার অর্থ হচ্ছে যে বেশি চর্বি খরচ হচ্ছে। (দেহে চর্বি ভাঙ্গার ফলে কিটোন উৎপন্ন হয়।) স্বাভাবিক অবস্থায় আপনার কিটোন মাত্রা কখনোই খুব বেশি বাড়ে না, এমনকি আপনি শর্করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করলেও না। উপকারী কিটোসিস ঘটার সময়, রক্তে কিটোনের মাত্রা থাকে নিম্ন থেকে মাঝারি মাত্রায়, চিনির মাত্রা থাকে স্বাভাবিক এবং রক্তের এসিড মাত্রা থাকে স্বাভাবিক (অর্থাৎ রক্ত বেশি এসিডিক হয় না)।
কিটো-আসিডোসিস কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা।
কিটোন কনাগুলো খানিকটা এসিডধর্মী, তাই আপনার রক্তে কিটোনের মাত্রা যদি খুব বেড়ে যায়, তাহলে আপনার রক্ত বেশি অম্লীয় হয়ে যেতে পারে (এই অবস্থাকেই বলা হয় 'আসিডোসিস' যা আসলেই একটি বিপদজনক অবস্থা)। তবে, পুষ্টিকর কিটোসিস এবং ভীতিকর কিটোএসিডোসিস অবস্থায় রক্তের কিটোনের পরিমাণ আকাশ পাতাল তফাৎ হয়।
উদাহরণ হিসাবে বসন্ত কালের মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাস এর সাথে হারিকেন ঝড়ের বাতাসের তুলনা করা যেতে পারেঃ আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে হারিকেন ঝড় এসে আপনার বসতবাড়িকে ধ্বসিয়ে দিক; কিন্তু বারান্দায় বসলে হাল্কা শীতল দক্ষিণা বাতাস কিন্তু খারাপ লাগে না, তাই না? উভয়ক্ষেত্রেই আমরা বাতাসের কথাই বলছি, কিন্তু তারা আসলে একই জিনিষ তো নয়। কিটোসিস এবং কিটোএসিডোসিস একদম সেইরকম।
বাস্তবতা হচ্ছে, পুষ্টিকর কিটোসিস শুধু নিরাপদই নয়, বরং মানব দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমের একটি স্বাভাবিক অংশ।
আপনি জানেন কি যে নবজাতকরা কিটোসিস অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে? কথাটি কিন্তু সত্য। শিশুদের বিপাক মাত্রা থাকে খুবই বেশি এবং তাই তারা প্রচুর চর্বি পোড়ায় এবং প্রায় সবসময় খুব বেশি মাত্রায় কিটোন উৎপাদন করে।
বিষয়টি বুঝানোর সুযোগ পেয়ে আমি খুব খুশি। এখন তাহলে খাবার থেকে শর্করা বাদ দিতে আমাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ থাকলো না। সত্য বলতে কি, আপনার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে এটি হচ্ছে সর্বাধিক শক্তিশালী হাতিয়ার।
আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে,
প্রফেসর ডাঃ এরিক ওয়েস্টম্যান, (মেডিক্যাল ডাক্তার)
Adapt Your Life ® Academy
(অনুবাদেঃ EasyHealthEducation.com)