ডাঃ শাহজাদা সেলিম কি বাংলাদেশ মেডিকেল বিস্ববিদ্যলয়ের প্রফেসর? সত্যি? এমন ডাহা মিথ্যা বলছেন একজন প্রফেসর ডাক্তার? তাও আবার সকলের জন্য উন্মুক্ত ইউটিউব ভিডিওতে? নিজের চোখ এবং কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!
এই ভিডিওটির কথা বলছিলামঃ
ভিডিওটা কয়েকবার দেখলাম। উনি নিজের পরিচয় দিচ্ছিলেন যেই জায়গাটাতে, সেখানটা খুব মন দিয়ে শুনলাম। তিনি বললেন "আমি ডাক্তার শাহজাদা সেলিম, সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডক্রিনোলজি বিভাগে"। নাহ, ভুল শুনছি না! কিন্তু বিশ্বাসও করতে পারছি না!
অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন বিশ্বাস কেন করতে পারছি না? চলুন কারণ গুলো একটা একটা করে বুঝিয়ে বলি। শুরু করি পরিচয় দিয়ে।
আমি শাহাদাৎ, আমেরিকান নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশান থেকে এডভান্সড কিটোজেনিক নিউট্রিশন ট্রেনিং নামে ডাক্তারদের জন্য তৈরি করা একটা ৬ মাসের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেছিলাম সেই ২০২০ সালে। 'এডভান্সড' পর্যায়ের কোর্স ছিল বিধায়, কিটোজেনিক নিউট্রিশন এর নাড়ীনক্ষত্র সব শেখানো হয়েছিল আমাকে। বাংলাদেশে আমিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিটোজেনিক নিউট্রিশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি ডাক্তার নই, প্রফেসর হবার তো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু কিটোজেনিক ডায়েট বিষয়ে আমি যেকোন ডাক্তারের তুলনায় বেশী জানি এবং বিস্তারিত জানি, এই দাবি অত্যন্ত বিনয়ের সাথেই করতে পারি।
প্রফেসর সেলিম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে তিনি বেশ নামকরা চিকিৎসা গবেষকও বটে! তবে কিটোজেনিক ডায়েট বা কিটোন বিষয়ে তিনি কোন গবেষণা করেছেন বলে খুঁজে পাইনি। তিনি কিটোজেনিক ডায়েট সম্পর্কে কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ করেছেন বলেও কোথাও দেখতে পেলাম না। অর্থাৎ, কিটোজেনিক ডায়েট সম্পর্কে ওনার জ্ঞান খুব সম্ভবত গুগল থেকে শেখা। একজন সাধারন রাম, শাম, যদু বা মধু যদি গুগল থেকে কিছু শেখে এবং সে ভিত্তিতে কিছু বলে, তাকে হয়তো ক্ষমা করে দেয়া যায়; কিন্তু একজন প্রফেসর ডাক্তার যদি তেমন করেন তাহলে একটু থমকে না গিয়ে উপায় থাকে না। একজন চিকিৎসক, গবেষক এবং প্রফেসর যে কথা বলেন, তার অধস্তন চিকিৎসকগণ তো বটেই, এমন কি সাধারন মানুষও সে কথাকে বিনা প্রশ্নে সত্য বলে মেনে নেবে এবং তাদের জীবনে কম বেশী পরিবর্তন করবে। তাই ওনার কথা বলার আগে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও যাচাই বাছাই করা অতি জরুরী। সত্য, অথবা কমপক্ষে বিজ্ঞান সম্মত তথ্য উপস্থাপন করা উচিৎ।
কিন্তু উপরোল্লিখিত ভিডিওতে তিনি কি এমন বলেছেন, তাই ভাবছেন তো? বলেছেন একগাদা ডাহা মিথ্যে কথা!
আজগুবি এক গল্প বললেন তিনি! গল্পটি খেয়াল করে শুনলে মনে হবে উনি হয়তো ধোঁওয়া টেনেছিলেন। গল্পমতে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের বন্দীদের মধ্যে যাদেরকে সর্বাধিক কষ্ট দিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করতো, তাদের কিটোজেনিক ডায়েট করতে বাধ্য করতো এবং তারা তিলে তিলে ভীষণ কষ্ট সহ্য করে মৃত্যুবরণ করতো। আউসউইটস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প জাদুঘরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে খোঁজ করে দেখলাম যে এই দাবিটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা! আপনারাও দেখে নিতে পারেন এখানেঃ https://www.auschwitz.org/en/history/life-in-the-camp/nutrition/
এরপরে কিটোজেনিক ডায়েট কে মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে দাবি করলেন তিনি। দলিল হিসাবে 'দ্যা লান্সেট' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার কথা বললেন যেখানে ১০ লক্ষাধিক মানুষ বারো বছর ধরে কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ করার পরে তাদের হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং সাধারন মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে দেখা গিয়েছিল। বাস্তবতা হল, এমন কোন গবেষণা আজঅব্দি দুনিয়াতে কোথাও হয়নি। উনি যে সকল উপাত্ত উপস্থাপন করলেন, তার ভিত্তিতে খুঁজলে ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি অতি নিম্ন মানের পর্যবেক্ষণমূলক (পরীক্ষামূলক নয়) সমীক্ষার সাথে কিছু মিল পাওয়া যায়। এই সমীক্ষার উপাত্তে দেখা গিয়েছিল যে যারা শর্করা খাওয়া খানিকটা কমিয়েছিল তাদের মধ্যে মৃত্যু হার বাড়তে দেখা গিয়েছিল। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ করেছিল, এমন দাবি স্বয়ং গবেষকগণ নিজেরাও করেন নি। কিটোজেনিক শব্দটিই খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই গবেষণায়। অর্থাৎ, ডাহা মিথ্যা কথা!
২০১৭ সালের মূল গবেষণার লিংক দেখুনঃ https://doi.org/10.1016/s2468-2667(18)30135-x
এই গবেষণার বিপরীতে অনেকগুলো প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংশোধনমূলক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। প্রকাশিত সংশোধনীর লিংকঃ https://doi.org/10.1016/s2468-2667(22)00118-9
৩য় যে ডাহা মিথ্যে কথাটি তিনি ওই ভিডিওতে বলেছেন, সেটি হচ্ছে কিটোজেনিক ডায়েটকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলে দাবি করা। অনেকের মতো আমারো মনে হয়েছিল যে উনি জানেননা বিধায় ভুল বলেছেন। কিন্তু সেটা ভুল! বিষয়টি এমন নয় যে ওনাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করা হয়েছিল বলে উনি যা মনে এসেছে বলে দিয়েছেন। বিষয়টি মোটেও তেমন ছিল না। যদি তর্কের খাতিরে আমরা ধরেও নেই যে তেমনটা ঘটেছিল, তাহলেও ওনার উচিৎ ছিল কিটোজেনিক ডায়েট বিষয়ে ওনার অজ্ঞতার কথা স্বীকার করা। না, বরং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে একটি ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছে এবং আলোচ্য বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়ার অনেক সময় ওনার হাতে ছিল। এমনকি আলোচনার শুরুতেই তিনি যে আসলে এই বিষয়ে বিশেষ কিছু জানেন না, সে কথা উল্লেখ করলেও হয়তো খানিক অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ হত। তিনি না জানা স্বত্বেও নিজেকে 'বিশেষজ্ঞ' হিসাবে জাহির করে, কিটোজেনিক ডায়েট সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য প্রচার করেছেন।
এখন কথা হল আমি কেন এই বিষয়ে এতো ভাবছি? দুটো কারণ। প্রথম কারণ হল, আমি যেহেতু এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত, তাই এই বিষয়ে যেকোনো অপপ্রচারের জবাবে সঠিক তথ্য সাধারণের সামনে তুলে ধরা আমার বিশেষ কর্তব্য। দ্বিতীয় কারণ হল, তিনি এমন একটি খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন, যে খাদ্যাভ্যাস সঠিকভাবে অনুসরণ করা সাধারন মানুষকে শেখালে, দেশের রূপ বদলে যাবে কয়েক মাসের মধ্যে! মেটাবলিক যে অসুখ গুলোর উপর ভিত্তি করে চলছে ডায়বেটিক সমিতি, হার্ট ফাউন্ডেশন, কিডনি ফাউন্ডেশন, হেন ফাউন্ডেশন, তেন ফাউন্ডেশন ইত্যাদি যেমন স্থূলতা, ২য় ধরনের ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, লিভার রোগ, পরিপাকতন্ত্রের রোগ, কিডনি রোগ, ত্বকের রোগ, হাড়ের রোগ, চোখের রোগ, দাতের রোগ, স্নায়ু রোগ, মস্তিষ্কের রোগ, মানসিক রোগ এবং এমনকি ক্যান্সার রোগ এর এই মহামারি, চোখের পলকে থেমে যেত। কিটোজেনিক ডায়েট বিষয়ে সর্বশেষ চিত্রটি জগতের সামনে তুলে ধরেছে ২০২৫ সালে প্রকাশিত এই গবেষণাটিঃ
https://doi.org/10.3390/nu17061047
এই সন্দেহ অমূলক নয় যে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে, বড় ডাক্তার হয়ে, গবেষক হয়ে, প্রফেসর হয়ে ওনার মতো অযোগ্য মিথ্যাবাদী জীবগুলি জোকের মত দেশের এবং দেশের মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। ডায়বেটিক রোগী যার দেহ খাবারের চিনির সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারে না এবং ফলে রক্তে চিনি বেড়ে যায়, সেই রোগীকে ওই ভিডিওতে তিনি কমপক্ষে ৫০% শর্করা জাতীয় খাবার খেতে নির্দেশনা দিচ্ছেন, অথচ শর্করা খাবার খাওয়াই মানুষের জন্য আবশ্যক নয় এবং একাধিক পরীক্ষামূলক উচ্চ মানের গবেষণায় দেখা গেছে যে শর্করা খাওয়া বন্ধ করলেই মানুষ সুস্থ হতে শুরু করে!
সবশেষে তাই বাক্যহারা হয়ে একটা কথাই ভাবছি...উনি একজন প্রফেসর?